Thursday, November 24, 2016

সাহিত্য বিচারে ইউসুফ জোলায়খা

ইউসুফ জুলেখা
সাহিত্য বিচারে ইউসুফ জোলায়খা
পবিত্র কোরআনে ইউসুফ নামে একটি বড় সূরা রয়েছে। কোরআন মজিদে নিছক একটি ঘটনা বর্ণনার ছলে বা ইতিহাসের উলে­­ হিসেবে সূরাটি বর্ণনা করা হয়নি। বরং আল­­াহ তাঁর স্থায়ী নিয়ম অনুযায়ী দীনের আসল দাওয়াত প্রচারেই তা অবতীর্ণ করেছেন। কোরআনে ইউসুফ জুলেখার প্রেমের কথা মুখ্য নয়। কোরআন এই পুরা কাহিনীতে দেখিয়েছে যে, পূর্ববর্তী নবী এবং ইউসুফের দীন তাই ছিল যা হজরত মুহাম্মদ (সঃ)- এর দ্বীন। আল­vহর রাসূল (সাঃ) সেই দীন কবুলের দিকে লোকদের আহবান দিচ্ছেন। কিন্তু পরবর্তীতে যারা কাহিনী অবলম্বন করে কাব্য রচনা করেছেন তাঁরা সূরাটির এই মর্ম পাশ কাটিয়ে জোলায়খার প্রণয়কে বেশি গুরচত্ব দিয়েছেন। 
যে সব খ্যাতনামা ফারসী কবি ইউসুফ জোলায়খার প্রণয় অবলম্বন করে  কাব্যোপাখ্যান লিখেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রধান  ইরানের মহাকবি ফেরদৌসী এবং সুফী কবি জামী আবদুর রহমান জামী ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ফারসী ভাষায় তাঁর অমর কাব্য ইউসুফ জোলায়খা রচনা করেন।  সেই কাব্যের অনুসরণে শাহ্ মুহম্মদ সগীর দেশীভাষে তার ইউসুফ জোলেখা প্রণয়ন করেন।

ইছফ-জলিখা কেচ্ছা কিতাব প্রমাণ।
দেশী ভাষে মোহাম্মদ ছগিরী ভান ।।

 ‘পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা কাব্যে মর্ত্যমানবের   বেদনার যে সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে, অষ্টদশ শতাব্দীর কাব্য সাধনায়  মানবতার নব- উদ্বোধন  তারই বিবর্তিত রূপ।
 ‘ইউসুফ জোলেখা বাংলা সাহিত্যে প্রথম মর্তলোকের মানুষের আকাংখা তথা সাধারণ জীবনের উৎসারণের সম্ভাবনাকে উন্মুখ আহবানে অভিষিক্ত করলো। বাংলাতে ইউসুফ জোলায়খা কাব্যের আদি রচয়িতা  শাহ্ মুহাম্মদ সগীর। শাহ মুহম্মদ সগীরের কাব্যে প্রেম রসে ধর্মবাণীর পরিবর্তে প্রেম রসে মানব বাণী প্রচার মুখ্য হয়ে উঠছে। তিনি প্রেমরস অবলম্বনে ধর্মবাণীর প্রচার করতে চাইলেও তা কাব্যে মানবীয় প্রেমকাহিনী হিসাবে রূপলাভ করেছে। কাব্যে দেখানো হয়েছে রূপজমোহ পার্থিব ভোগতৃষ্ণার বিষয়। ইন্দ্রিয় সম্ভোগবাসনা দ্বারা অতীন্দ্রিয় পরমাত্মাকে পাওয়া যায় না, অন্তরের প্রেম দ্বারাই তাকে পাওয়া সম্ভব। বিচ্ছেদের মধ্যে ত্যাগ-তিতিক্ষার দ্বারা জোলেখা যেদিন সেই প্রেম সাধনায় জয়ী হয়েছেন, সেদিন পরমাত্মা নিজেই এসে ধরা দিয়েছেন। উভয়ের মিলন হয়েছে।’ 
ইউসুফ জোলায়খা রোমান্টিক কাব্যোপাখ্যান হওয়া সত্ত্বেও, কবি তার বর্ণনাভঙ্গিতে পরিচিত সমাজ সংসার জীবনের বন্ধনকে স্বীকার করেছেন। শাহ মুহম্মদ সগীর তার রচনায় মুসলিম বিশ্বাস জীবনাচরণের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। তিনি যখন বলেন : 
ইছুফে বলিলা দুই বাধা অছে বড়।
আজিজক ভয় আর নিরঞ্জন ডর\
আজিজক কৃপাণ শমন সমসর।
শিরছেদ করিয়া পাঠাইব যমঘর\
ধর্মেতে বিরোধ হয় এহি আর ভয়।
পরলোকে নরকে ডুবিব অতিশয়\
তখন যে ধর্ম- বিশ্বাস   পাপ-পূণ্যবোধের বাণী উচ্চারিত হয় তার সাথে মুসলিম জীবন দর্শনের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। রচনা সম্পর্কে ডঃ ওয়াকিল আহমদ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, মুহম্মদ সগীর কুরআনকে ভিত্তি করে ইসলামি শাস্ত্র, ইরানের আধ্যাত্মিক কাব্য ভারতের লোক কাহিনীর মিশ্রণে ইউসুফ জোলেখা কাব্যের পূর্ণাঙ্গ কাহিনী নির্মাণ করেছেন।
ইউসুফ জোলেখা কাব্যের অন্যান্য রচয়িতা হচ্ছেন আবদুল হাকিম, গরীবুল­­াহ, গোলাম সফাত উল­­াহ,
কুরআন শরীফ বাইবেলে ইউসুফ জোলেখার কাহিনী নৈতিক উপাখ্যান হিসাবে ব্যক্ত হয়েছে। কোরআনে হজরত ইউসুফের চরিত্রে সংযমশীলতা আল­­াহ- নির্ভরতার চরম পরিচয় রয়েছে। পক্ষান্তরে প্রেমময়ী নারী জোলায়খার কামনা বাসনার চরম পরিচয় বিধৃত হয়েছে কোরআনে। কোরআনের কাহিনী ইউসুফ জোলেখার প্রেম কাহিনী নয়- ইউসুফ [আঃ] এর প্রতিষ্ঠার কাহিনী। একজন নবীর প্রতিষ্ঠার কাহিনীকে গৌণ করে সেটিকে প্রেমোপাখ্যানে পরিণত করা সাহিত্যের আদালতে অপরাধ না হলেও নৈতিকতার দিক দিয়ে নীচ সন্দেহ নেই।

অবশ্য কোরআন কাব্য গ্রন্থ নয়, তাই কবিগণ তাঁদের সাহিত্যে তার হুবহু অনুকরণের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। তাই সাহিত্যের মানে উত্তীর্ণ হলেও কোরআনের খেলাফ বর্ণনা একজন রসুলের নাম চালিয়ে দেয়া নৈতিকতার দিক দিয়ে পাপ কাজ।

No comments:

Post a Comment