Thursday, April 27, 2017

চরিত্রায়নঃ স্বল্প সংখ্যক চরিত্রের সমবায়ে গঠিত এ কাব্যনাট্যে মাত্র দুটি চরিত্রই সর্বত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছে। সে দুটি চরিত্র হচ্ছে কাহিনীর নায়ক ‘নৌফেল’ ও প্রতি নায়ক ‘হাতেম’। গ্রন্থের নামকরণে প্রকৃতপক্ষে দুটি চরিত্রের প্রাধান্যের স্বীকৃতি প্রকাশ পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। দুটি চরিত্রের মধ্যে ‘নৌফেল’ চরিত্রাংকনেই ফররুখ আহমদের কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে বেশি। চরিত্র কোন বিশেষ ভাবনার নির্জীব প্রতীক মাত্র হয়ে দাঁডায়নি, সজীব মনুষ্য চরিত্রেরই মহিমা লাভ করেছে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নৌফেল একটি রক্তমাংশের তাজা মানুষ হয়েই দেখা দিয়েছে। বিপুল ঐশ্বর্য্য অতুল প্রতাপের অধিকারী নৌফেলের অদ্ভুত যশোলিপ্সা কিভাবে তাঁকে দারাজ-দিল হাতেম তা’য়ীর প্রতি ঈর্ষান্বিত করে তুলে ধাপে ধাপে পশুত্বের স্তরে নামিয়ে এনেছে, তা কবি সুক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের নৈপূন্যসহকারে প্রদর্শন করেছেন। 

কর্মের কুটিল পথ আশ্রয় করে বিষিয়ে তুলেছিলেন নিজের সমগ্র জীবনকে, নিজের অস্তিত্বকে করে তুলেছিলেন দুর্বিসহ হারিয়ে ফেলেছিলেন জীবনের প্রশান্তি, তা কবি অতি সুক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি সহকারে বিশ্লেষন করে দেখিয়েছেন। তারপর কেমন করে নৌফেল মহৎ চরিত্রের ইশারা গ্রহণ করে জেগে উঠলেন জীবনের সুর্যালোকে তা কবি অতি সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন। নৌফেলের অন্তর্দ্বন্দ্বের বর্ণনায় জীবন শিল্পী ফররুখ যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। মোট কথা, এ চরিত্রাংকনে ফররুখ ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার সুলভ বাস্তব দৃষ্টির সাথে কবি সুলভ সুক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন বলতেই হয়। 

তুলনামূলকভাবে, হাতেম চরিত্রাংকনে ফররুখ তেমন কোন স্বার্থকতা লাভ করতে পারেন নি, হাতেম চরিত্র একটা আদর্শের নির্জীব প্রতিমূর্তি হয়ে দেখা দিয়েছে। তাকে কখনই রক্তমাংশের মানুষের মত বাস্তব বলে বোধ হয় না। লক্ষ করার বিষয়, নাটকে হাতেম চরিত্র প্রায়শঃই নেপথ্যাশ্রয়ী। লোকমুখে ভেসে আসে তাঁর সুখ্যাতির কথা আর তাই আমাদের মনের কোণে উজ্জ্বল বিভায় মূর্ত করে তোলে এক সেবাব্রতী মানব বন্ধু রুপকে। নৌফেল তাঁর সৌভাগ্য ও সুনামের কাল্পনিক প্রতিবাদীকে চোখে বড় একটা দেখেননি, যখন দেখতে পেলেন তখন তিনি হয়ে দাঁডালেন রাহুমুক্ত চাঁদের মত মনুষত্বের বিভায় উজ্জ্বল। 

এ নাটকে আমরা তাঁর স্বাক্ষাতকার পাই মাত্র চারটি দৃশ্যে, একবার নৌফেলের ইয়েমেন মুল্লুক আক্রমণের পূর্বমূহুর্তে বৃদ্ধ বাদশাহ তায়ীর সাথে কথোপকথনরত অবস্থায়, একবার প্রাচীন কোন শহরের রাজপথে রুগ্ন গরীব এক মুটের বোঝা বহনরত অবস্থায়, একবার নৌফেলের রাজ্যে বনপথে কাঠুরিয়া পরিবারের সাথে সাক্ষাত এবং সর্বশেষ বৃদ্ধ কাঠুরিয়ার বন্দী হিসেবে নৌফেলের দরবারে কাঠুরিয়াকে বিঘোষিত পুরস্কার দেবার জন্য অনুরোধ করতে। সর্বত্রই লক্ষ্য করা যায় তিনি ত্যাগ, ক্ষমা, স্নেহ, প্রেম, সেবা, ভালোবাসা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয়ের সাধনায় রত। দীন-দুনিয়ার কল্যাণ ছাড়া জীবনের তার অন্য কোন ভাবনা নাই। তিনি স্নেহ, প্রেম, ভালবাসা, করুণায় বিগলিত চিত্ত একট অতি সুন্দর মানুষ। সেবা ধর্মের মহিমায় তাঁর অটল বিশ্বাস। শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে তিনি সকলের জন্য বোধ করেন মমত্ব। সামান্যতম বিরুপতা জাগেনা তার মনে প্রাণে কারও সম্পর্কে। নৌফেল তাঁকে রাজ্য ছাড়া গৃহহারা করেছেন, তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছেন, তার পরিবর্তে হাতেম শুনিয়েছেন তাঁকে প্রেম ও কল্যাণের বাণী। যে খ্যাতির জন্যে তাঁর বিরুদ্ধে নৌফেলের সংগ্রাম সে সংগ্রামেও হাতেম নির্বিকার। 

হাতেম এক অটল অনড় আদর্শ বিশ্বাসী মানুষ। আলোচ্য নাটকে তিনি যেন সব মানবিক সদগুণেরই যেন একটি প্রতিমূর্তিরুপে উপস্থিত। কোন মানবিক দূর্বলতা ও বিকার এ চরিত্রে লক্ষ্য করা যায় না। হাতেম চরিত্র তাই যেন একটা আইডিয়া রুপেই এই নাটকে দেখা দিয়েছে। ঠিক রক্তমাংশের মানুষ রুপে দেখা দেয়নি। চরিত্রটি নিঃসন্দেহে একমাত্রিক তাই অতিমানবীয়। 

এ কাব্যনাট্যে কবি বোধ হয় সর্বাধিক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন অতি সাধারণ স্তরের নরনারীর চরিত্র চিত্রনে। স্বল্পাক্ষরে অংকিত এ চরিত্রগুলোর মুখে তিনি যে প্রাণবন্ত সংলাপ জুড়ে দিয়েছেন তাতেই এরা জীবন লাভ করেছে। প্রসঙ্গত গুপ্তচর, মূটে, বৃদ্ধ কাঠুরিয়া ও তার স্ত্রী পুত্রাদির চরিত্রগুলোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। উজীর, সিপাহ সালার, আমীর, শায়ের, ভাঁড়, মোসাহেব, ইয়েমেনের বৃদ্ধ বাদশাহ ইত্যাদি চরিত্র বিশেষত্ব বর্জিত। মুর্শিদের সত্যনিষ্ঠ চরিত্রের দৃঢ়তাজ্ঞাপক মুর্তিটে অবশ্য মন্দ হয়নি। 

নারী চরিত্রের প্রায় অনুপস্থিতি এ নাটকের আরেকটি লক্ষনীয় বৈশিষ্ট্য। একমাত্র নৌফেল বাদশাহর বেগম চরিত্রটি ছাড়া উল্লেখযোগ্য নারী চরিত্র এ নাটকে নাই বললেই চলে। তাও আবার বেগম চরিত্রটির ভূমিকা নিতান্তই গৌণ এবং অনুল্লেখযোগ্য। নাটকের নায়ক চরিত্রের বিবর্তনে তাঁর একটি ক্ষুদ্র ভূমিকা আছে, শুধু এটুকু আমরা তাঁর সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলতে পারি। তবে মুলতঃ নেপথ্যাশ্রয়ী চরিত্রের ভুমিকাই সে পালন করেছে। 

No comments:

Post a Comment