নৌফেল ও হাতেম কোনো গতানুগতিক কাব্যনাট্য নয়। এটি স্থান পেয়েছে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ-সফল কটি কাব্যনাটকের তালিকায়। ভাষা, শব্দ, ছন্দ, কাব্য-ঐশ্বর্যের সঙ্গে নাট্যগুণ, পঠিতব্যতা ও অভিনয়-উপযোগিতা ইত্যাদি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কাব্যনাটকটির শিল্পমূল্যের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সমকালের প্রায় সকলেই সোৎস্ফুর্তভাবে। কাব্যনাটকটির কাহিনিসূত্র খুব স্বল্পপরিসর, সামান্য ও সাধারণ। কিন্তু তিনি সামান্যোর মধ্যে অসমান্যকে, সাধারণের মাঝে অসাধারণকে ধারণ করতে পেরেছেন কবিপ্রতিভার শক্তি দিয়ে। স্বল্পসূত্র কাহিনী দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি অঙ্কে প্রায় পনেরটি চরিত্র। নাটকের মূলবক্তব্য: পঙ্গুত্ব থেকে মনুষত্বের দিকে ধাবন, মহত্তম মাবতার উজ্জীবন। হিংসা-বিদ্বেষ, জুর-জুলুম, অহঙ্কার-অত্যাচার, যশলি≈v-উচ্চাভিলাষ ইত্যাদির মতো হীনকর্ম পরিত্যাগ করে প্রেম-ভালবাসা, ত্যাগ-পরোকার, বিনয়-ন্যায়, যশবিমুখতা ও উদারতার দিকে প্রত্যাবর্তন।
ফররুখ আহমদের এ-কাব্যনাটকে আদর্শের সঙ্গে জৈবিক বাস্তবতার সঙ্ঘাত, ব্যক্তিক অসৎ মানসিকতার সঙ্গে সামাজিক সৎ মানসিকতার দ্বনদ্ব এবং লোভ-মোহের পরিবর্তে ত্যাগ, বিনয় ও সেবাব্রতের জয় শিল্পকৌশলে চিত্রিত হয়েছে। কবি এই নাট্যকাহিনীতে যশখ্যাতির প্রতি মানুষের মোহ এবং যাবতীয় কূটকৌশল অবলম্বন করেও তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ বা আকাক্মিখত কোনো কিছুর অপ্রাপ্তির মুখে প্রতিশোধস্পৃহা কতটা হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে, তা নৌফেল চরিত্রে প্রকাশ করেছেন। মানবতার বিপর্যয়, পশুত্বের কাছে মনুষত্বের পরাজয়, মানবত্মার ক্রন্দন, মানুষের বিকেপতন কবিতে পীড়িত করেছে ভীষণভাবে। তাকে ব্যথিত করেছে মানুষের নীচতা-হীনতা। তারপরও মানুষের প্রতি মানবতার প্রতি তার বিশ্বাস লুপ্ত হয় নি, ক্ষয়ে পড়ে নি। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন মুক্তি ও সুষ্ঠু বিকাশ, জড়ত্বের দাসত্ব থেকে মুক্তির আকুতিই কবিতার শিল্পরূপে উপস্থাপিত হয়েছে শব্দ-ছন্দের গাথুনিতে, চিন্তার বুনুনিতে, বলার ভঙ্গিতে ও সঙ্গীতে। আর এই মানসবৃক্ষের মিষ্ট ফল হিসেবে আমরা পেয়েছি নৌফেল ও হামের মতো একটি অবনদ্য কাব্যনাট্য।
নৌফেল সর্বস্ব বিলানোর পরও হাতেমের মতো যশ খ্যাতি অর্জনে ব্যর্থ হয়ে হাতেমের রাজ্যলুটের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে অত্যন্ত নীচু মানুসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তথাপি একথা সত্য যে, মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি না ঘটলে, তার মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। তার প্রতিটি স্নায়ু-কোষে জ্বলে ওঠে জাহান্নাম। তার অতন্দ্র রাত শেষ হয় তীব্র বিষে। তিক্ত বিষ সয়ে-সয়ে চলে তার জীবন-যৌবন। নৌফেলের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। সে অহঙ্কারি, অত্যাচারি, ক্ষমতালোভী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। তার ক্ষোভাগ্নিভরা কণ্ঠ চিরে তাই বের হয়ে পড়ে,
আমাকে দিওনা বাধা। প্রতি রন্ধে, প্রতি স্নায়ু-কোষে
জ্বলে কোন জাহান্নাম রাত্রিদিন, তুমি তা জানো না।
আমার অতন্দ্র রাত্রি শেষ হয় কোন তীব্র বিষে
জানো না তুমি; কেউ তা জানে না। তবু আমি
আপ্রাণ চেষ্টার সেই তিক্ত বিষ সয়েছি জীবনে
দীর্ঘকাল। ভেবেছি অহেতু আমি আত্মপ্রতারিত
জ্বলে কোন জাহান্নাম রাত্রিদিন, তুমি তা জানো না।
আমার অতন্দ্র রাত্রি শেষ হয় কোন তীব্র বিষে
জানো না তুমি; কেউ তা জানে না। তবু আমি
আপ্রাণ চেষ্টার সেই তিক্ত বিষ সয়েছি জীবনে
দীর্ঘকাল। ভেবেছি অহেতু আমি আত্মপ্রতারিত
নৌফেল
হাতেমের যশখ্যাতিকে ভস্ম করে নিজে খ্যাতিমান হয়ে ওঠার যাবতীয় কলাকৌশল করে দেখেন। কিন্তু পরীক্ষায় সে ফেল মারে।
সব অস্ত্র সে ব্যবহার করে
দেখেছে। কিন্তু কোনো অস্ত্র তার লক্ষ্য ভেদ করতে পারেনি। এখন তার হাতে একটিমাত্র অস্ত্র: ক্ষমতার শক্তি প্রয়োগ করে, কাট-কাট-মার-মার শব্দ তুলে লুটতরাজ করা, অন্যদেশে অন্যায় হানা দেয়া, অতর্কিতে হামলে পড়া এবং নিরপরাধ ব্যক্তিদের দিয়ে বন্দীশালা ভর্তি করা। সেই আখেরী অস্ত্রটিও ব্যবহার করতে ভুলে যায় নি নৌফেল।
তাই সে ক্ষোভঝরা কণ্ঠে
হুঙ্কার ছাড়ে,
....প্রয়াসী
আমার
মেলে
সে খ্যাতি যশ সর্বস্ব বিলিয়ে;
ঘৃণা আমি
পাই
প্রতিদানে। কুড়াই কুখ্যাতি শুধু। তাই আমি
No comments:
Post a Comment